পহেলা বৈশাখ- বাঙালির প্রাণের উৎসব- প্রবাসে মাটিতে পহেলা বৈশাখ উৎযাপন

আরো পড়ুনঃ এডিটিং সফটওয়্যারের জনপ্রিয় ও সেরা টুলস

পহেলা বৈশাখ, বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন, এই দিনটি বাঙ্গালীর জাতীয় জীবনে অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং আবেগঘন একটি উৎসবের দিন। এটি শুধু একটি ক্যালেন্ডারের তারিখ নয়, বরং এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বাঙ্গালীর সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও জাতিসত্তার প্রতীক।

প্রতি বছর বাংলাদেশে ১৪ এপ্রিল এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ১৫ এপ্রিল, এই দিনটি পালন করা হয়, বিভিন্ন উৎসব মুখর পরিবেশে। শহর থেকে শুরু করে গ্রাম পর্যন্ত সবখানেই মানুষ বৈশাখের নতুন পোশাকে সেজে গান, নিত্য, মেলা এবং আয়োজন করে বিভিন্ন সংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের।

পহেলা বৈশাখের বিশেষ এই দিনকে উপলক্ষ করে কাছে টানে একে অপরকে, গড়ে উঠে নতুন এক সম্প্রীতির বন্ধন। আর আজকের আর্টিকেল আমরা আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করবো, " পহেলা বৈশাখ, বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন"কে নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা। চলুন তাহলে আমরা দেখি- 

পহেলা বৈশাখের ইতিহাস ও উৎপত্তি

বাংলা ক্যালেন্ডারের সূচনা

বাংলা সনের সূচনা সম্পর্কে যদিও বিভিন্ন মতভেদ রয়েছে, তবে প্রাচীন প্রামাণ্য দলিল অনুযায়ী, মুঘল সম্রাট আকবর উদ্দ্যোগ নেন বাংলা এই ক্যালেন্ডারের। তিনি তাঁর খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য, সৌর ও চন্দ্র মাসের ক্যালেন্ডারকে সমন্বয় করে তৈরি করেন বাংলা সনের।

বাংলা সাল মূলত গণনার শুরু হয় ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে, যা কার্যকর হয়েছিল, ১০ মার্চ বা ১১ মার্চ ১৫৫৬ সালে, মুঘল সম্রাট আকবরের সিংহাসনে আরহণের দিন হিসাবে।

পহেলা বৈশাখ নাম করণ

পহেলা শব্দের অর্থ প্রথম, আর বৈশাখ হলো বাংলা বছরের বা সালের প্রথম মাস। তাই, পহেলা বৈশাখ মানেই হলো, বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন। এটি শুধু একটি দিন নয় বরং নতুন বছরের আগমন, নতুন সূচনা, নতুন আশা, সম্ভাবনা ও আনন্দের প্রতীক হিসাবে, বিশেষ তাৎপর্য বহন করে বাঙ্গালী জীবনে।

বাঙ্গালী জীবনে পহেলা বৈশাখের তাৎপর্য

নতুন সূচনা ও আশার প্রতীক

পুরনো বছরের সকল গ্লানি, ব্যর্থতা, স্মৃতি এবং দুঃখ বেদনাকে ভূলে গিয়ে, বাঙ্গালীরা নতুন উদ্দীপনায় শুরু করেন। মানুষ এই দিনকে ঘিরে আগামী ভবিষ্যতের জন্য তৈরি করেন পরিকল্পনা ও লক্ষ নির্ধারনের পাশাপাশি আশার প্রতিক হিসাবে দেখেন এই দিনটিকে ঘিরে।

ব্যবসায়ীদে হালখাতা

বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ব্যবসায়ীদের মাঝে এই দিনকে ঘিরে হাল খাতা নামে দিনটি পালন করেন। এই দিনে পুরনো দেনাদারদের দাওয়াত করে, মিস্টিমুখ করে দেনা মেটানোর চেস্টা করেন এবং খোলেন নতুন খাতা, যেখানে শুরু হয় নতুন বছরের লেনদেন।

সামাজিক সম্প্রীতি ও মিলন মেলা

পহেলা বৈশাখকে উপলক্ষ করে তৈরি হয় পারিবারিক, সামাজিক এবং সংস্কৃতির এক নতুন বন্ধন। বন্ধু- বান্ধব, আত্নীয়স্বজন এবং প্রতিবেশিদের সঙ্গে সুবেচ্ছা বিনিময়ের মাধ্যমে আরো সুদৃঢ় হয় সম্প্রীতিক বন্ধন।

পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান ও আয়োজন

ছায়ানটের অনুষ্ঠান ও রমনা বটমূলে সূর্যোদয়

পহেলা বৈশাখের এই দিনে ঢাকার রমনা বট্মূলে ছায়ানট নামের এমটি সাংস্কৃতিক সংগঠন, সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে নতুন বছরকে বরণ করেন রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশনের মাধ্যমে। এটি হল পহেলা বৈশাখের অন্যতম প্রধান আয়োজন।

ঐতিহ্যের প্রতিক মঙ্গল শোভাযাত্রা

ঢাকা বিশববদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে শুরু হওয়া এই মঙ্গল শোভাযাত্রাটি, এখন শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও প্রশংসিত। ২০১৬ সালে ইউনেস্কো এটিকে স্বীকৃতি দেয় বিশ্ব সাংস্কৃতির ঐতিহ্য হিসাবে। শোভাজাত্রায় বিভিন্ন ধরণের মুখোশ, প্রতিকী পুতুল, ব্যানারের মাধ্যমে অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে জয় প্রকাশ করা হয় শুভতার।

মেলা ও পান্তা ইলিশ

দেশের বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত হয় বৈশাখী মেলে। মেলায় পাওয়া যায়, কাঠের খেলনা, মাটির জিনিস, হস্তশিল্প এবং গ্রামীন খাবার। আর পহেলা বৈশাখের খাদ্যের প্রধান আকর্ষণ পান্তা ইলিশ। যদিও, এটি বিতর্কিত ও এলাকা ভেদে ভিন্ন হতে পারে, তবে খাবারটি শহরে এক প্রকার রীতিতে পরিণত হয়েছে।

পহেলা বৈশাখে সাংস্কৃতিক কার্যক্রম

কবিতা, গান ও নৃত্য

বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন এই দিনে আয়োজন করে, কাজী নজরুল ইসলাম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুন এবং বিভিন্ন বাঙ্গালী কবির কবিতা ও শিল্পীদের গানের অনুষ্ঠান। এছাড়াও, পরিবেশন করা হয়, নৃত্য, লোক সঙ্গীত ও নাটক, যা পহেলা বৈশাখের অনুষঙ্গ।

রঙ্গীন পোশাক ও ফ্যাশন

পহেলা বৈশাখের এই দিনে সকল নারীদের পরণে থাকে সাদা পাড়যুক্ত লাল শাড়ী এবং ছেলেদের পাঞ্জাবি ফতুয়া এবং বর্ণিল পোশাক। তাছাড়া, নারীরা খোপায় গুজে নেয় রঙ্গীন ফুল, আর পুরুষেরাও পরেন ঐতিহ্যবাহী বাঙ্গালী পোশাক।

পহেলা বৈশাখের আধুনিক প্রেক্ষাপট

নগর জীবনের সঙ্গে মিলন

বর্তমানে পহেলা বৈশাখ শুধুমাত্র গ্রামীন উৎসবের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং বিস্তার লাভ করেছে নগরজীবন পর্যন্ত। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্পোরেট অফিস, এমনকি বিদেশে থাকা প্রবাসী বাঙ্গালীরাও এই দিনটি উৎযাপন করে থাকে।

পহেলা বৈশাখ ও প্রযুক্তি

বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় শুভ নববর্ষ জানানো, ভার্চুয়াল শুভেচ্ছা বিনিময় এবং নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে অনলাইন লাইভ কনসার্ট উৎসব।

অর্থনৈতিক গুরুত্বে পহেলা বৈশাখ

ব্যবসায়িক সিজন ও ব্র্যান্ডিং

পহেলা বৈশাখের এই দিনটিকে উপলক্ষ করে দেশের বিভিন্ন বিপনিবিতান, অনলাইন শপ ও বিভিন্ন ব্র্যান্ড তাদের প্রমোশন ও ডিসকাউন্ট অফার দেওয়ার মধ্য দিয়ে, ব্যবসার প্রসার ও প্রচার শুরু করেন। এখন এটি দেশের অর্থনীতির জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

পহেলা বৈশাখ সম্পর্কে সমালোচনা ও বিতর্ক

পান্তা ইলিশের বাজারদর

ইলিশ মাছের দাম এই দিনে অনেক বেড়ে যায়, যা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলা যায়, এই বিষয়টি প্রতিবছর বিভিন্ন আলোচনার জন্ম দেয়।

ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সমালোচনা

কখনো কখনো কিছু গোষ্ঠী পহেলা বৈশাখের এই উৎসবকে অপসংস্কৃতি এবং ইসলাম ধর্ম বিরোধী হিসাবে আখ্যা দিয়ে থাকে, যদিও এই উৎসবটি একটি অন্যতম ধর্মনিরপেক্ষ  সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের বহিঃ প্রকাশ।

পহেলা বৈশাখে বিশ্বদৃষ্টি ও প্রবাসে উৎযাপন

প্রবাসী বাঙ্গালিদের অংশগ্রহন  

বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন প্রবাসী বাঙ্গালীরা কমিউনিটি সেন্টার, বাংলাদেশ হাইকমিশন ও বাঙ্গালী সংগঠনের মাধ্যমে এই দিনকে উদযাপন করে। বিশ্বের বিভিন্ন শহর যেমন, নিউ ইয়র্ক, টরেন্ট, লল্ডন এবং সিডনীসহ উন্নত শহরেও পহেলা বৈশাখে বৈশাখী মেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়।

প্রবাসে মাটিতে পহেলা বৈশাখ উৎযাপন

এটি বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ ছাড়িয়ে, ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা, বাঙ্গালী প্রবাসীদের মধ্যেও, যা বাংলা নববর্ষ একটি আবেগঘন সংস্কৃতি হয়ে দাড়িয়েছে। নিউ ইয়র্ক, লল্ডন, সিডনি, টরেন্ট, দুবাই বা কুয়ালালামপুর যেখানেই বাঙ্গালী বসতি রয়েছে, সেখানেই বিভিন্ন আয়োজনে নববর্ষের আনন্দ উতযাপিত হয়।

প্রবাসে থাকা কমিউনিটিগুলো এই দিন উপলক্ষে আয়োজন করে বৈশাখী মেলা, র‍্যালী, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইত্যাদি। অনুষ্ঠানে পরিবেশিত হয়, বাঙ্গালী খাবার, দেশীয় নাচ, গান, কবিতা পাঠ ও পরিধেয় পোশাক। স্থানীয় বিদেশিরাও অনেক সময় এই সকল আয়োজনে অংশগ্রহন করে, যা বাংলা সংস্কৃতি পরিচিতি পায় বিশ্বের দরবারে।

বাঙ্গালী চেতনাবোধে পহেলা বৈশাখ- শেষকথা

বাঙ্গালীদের কাছে পহেলা বৈশাখ শুধু একটি দিন নয়, বাঙ্গালী চেতনাবোধে, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও নতুন সূচনার প্রতীক। বৈশাখের মেলা, রঙ, গান, মানুষের হাসিমুখ সব মিলিয়ে বাংলা নববর্ষ সত্যিই, বাঙ্গালী জীবনে অমলিন আনন্দ ও গর্বের দিন। জাতি, ধর্ম, বর্ণ সকলেই মিলিত হয় এই উৎসবে, কারণ আমাদের সবার একটাই পরিচয় আমরা বাঙ্গালী।

প্রিয় পাঠক পাঠিকাগণ, আমরা আশাকরি আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করতে পেরেছি, "পহেলা বৈশাখ- বাঙালির প্রাণের উৎসব- প্রবাসে মাটিতে পহেলা বৈশাখ উৎযাপন" সম্পর্কে। যা আপনাদেরকেও দিনটি উৎযাপনে উৎসাহিত করবে বলে আমরা আশাবাদী।

আরো পড়ুনঃ কিভাবে একজন সফল ফ্রিল্যান্সার হওয়া যায়

আর্টিকেলটি যদি আপনাদের ভালোলাগে এবং উপকারি বলে মনে হয়, তাহলে এটি অন্যের সঙ্গে শেয়ার করবেন, তারা যেন উপকৃত হন। আরো নতুন নতুন তথ্য জানার জন্য আমাদের পরবর্তী আর্টিকেল পড়ুন এবং আমাদের সঙ্গে থাকুন, ধন্যবাদ।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url