হরমোন মানুষের দেহের গোপন নিয়ন্ত্রক- হরমোন কী? প্রকারভেদ, কাজ ও শরীরের উপর প্রভাব

আরো পড়ুনঃ মেয়েদের জরায়ু ক্যানসারের কারণ ও লক্ষণ কি?- জরায়ু ক্যানসারের চিকিৎসা ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা

হরমোন মানুষের শরীরের এক ধরণের রাসায়নিক বার্তাবাহক, যা নিয়ন্ত্রণ করে শরীরের বিভিন্ন কার্যক্রম। এইগুলী শরীরের গ্রন্থী থেকে নিঃসৃত হয় এবং রক্তের মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন স্থানে পৌছায় ও মানসিক, শারীরিক প্রজনন ও বৃদ্ধি কার্যক্রমের সমন্বয় ঘটায়।

সকল প্রকার হরমোনের আলাদা আলাদা কাজ থাকে এবং তাদের ভারসাম্য বজায় রাখাটা খুবই জরুরি। আজকের আর্টিকেলে আমরা আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করবো, হরমন কি? এর কাজসহ বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা। চলুন তাহলে দেখি- 

হরমোন কি?- what is hormone

হরমোন হলো মানুষের শরীরের থাকা বিশেষ এক ধরণের রাসায়নিক পদার্থ, যা শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ বা গ্রন্থির মাধ্যমে নিঃসৃত হয় এবং রক্ত চলাচলের মাধ্যেম শরীরের বিভিন্ন যায়গায় পৌঁছে তাদের কার্যক্রমকে পরিচালনা করে।

সহজ কথায় বলা যায়, হরমোন আমাদের শরীরের অভ্যান্তরীন পরিবেশ সঠিক রাখতে সাহায্য করে এবং জীবনের বিভিন্ন প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। হরমোনের প্রভাব কেবলমাত্র শরীরিক নয়, মানসিক ও আবেগগত দিক থেকেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

কোন ছোট হরমোনের পরিবর্তনের ফলে, পরিবর্তন ঘটতে পারে শরীরে বড় ধরণের, যেমন রক্তচাপ বৃদ্ধি, শারীরিক পরিবর্তন বা মেজাজের পরিবর্তন। হরমোন যেমন বিভিন্ন প্রকার হয়, তেমনি তাদের কাজও ভিন্ন রকমের। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা জানবো।

হরমোনের উৎপত্তিস্থল- Origin of hormones

হরমোনের মূলত উৎপত্তি হয়, বিভিন্ন গ্রন্থি থেকে। আর এই সকল গ্রন্থি বা গ্লান্ড বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে শরীরের এবং তারা নিঃসৃত করে হরমোন। হরমোনের এই গ্রন্থিগুলোকে ভাগ করা হয় দু'ভাগে। যেমন- 

এন্ডোক্রাইন গ্রন্থি- Endocrine Glands

এই সকল গ্রন্থিগুলি চ্যানেল বা স্নায়ুতন্ত্রের দ্বারা কোন ধরণের হরমোন নিঃসরন করে না বরং হরমোন মুক্ত করে সোজাসুজি রক্তপ্রবাহের। যেমন- থাইরয়েড, পিটুইটারি গ্রন্থি, অ্যাড্রিনাল গ্রান্থি, প্যাঞ্চচ্রিয়াস, গোনাদস (অণ্ডকোষ ও ডম্বাশয়)।

এক্সক্রাইন গ্রন্থি- Exocrinr Glamds

এই গ্রন্থিগুলো বিশেষ কোন চ্যানেল বা নলের দ্বারা হরমোন নিঃসরণ করে, যা শরীরের বাইবের কোন অংশে চলে যায়। যেমন- ঘাম গ্রন্থি, লালা গ্রন্থি, দুধ উৎপাদনকারী গ্রন্থি ইত্যাদি।

হরমোন কয় প্রকার ও কি কি?- How many types of hormones are there and what are they?

হরমোন প্রধাণত তিন প্রকার বা ধরণের হয়ে থাকে। নিম্নে এই সকল হরমোনের বিষয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো- 

প্রোটিন বা পেপ্টাইড হরমোন- Protein or peptide hormones

সাধারণত এই সকল হরমোনগুলো প্রোটিন বা পেপটাইড চেইনের মাধ্যমে গঠিত হয়ে থাকে। আর এই হরমোনগুলো শরীরের রক্তের মাধ্যমে দেহের বিভিন্ন অংশে পৌছায় এবং নির্দিষ্ট প্রভাব বিস্তার করে বিভিন্ন কোষের উপর। যেমন- গ্লুকাগন, ইনস্যুলিন, গ্রথ হরমোন ইত্যাদি।

স্টেরয়েড হরমোন- Steroid hormones

স্টেরয়েড হরমোন লিপিড বা চর্বির মাধ্যমে তৈরি এবং এগুলো খুব সহজে প্রবাহিত হতে পারে কোষের ঝিল্লির মাধ্যমে। যেমন- এস্ট্রোজেন, প্রোজেস্টেরন, টেস্টোস্টেরন, করটিসোল ইত্যাদি।

এমিনো অ্যাসিড থেকে উৎপন্ন হরমোন- Hormones produced from amino acids

এগুলো হরমোন এমিনো অ্যাসিড (যথা টায়রোসিন) থেকে সৃষ্টি হয়। যেমন- থাইরক্সিন, অ্যাড্রেনালিন ইত্যাদি। 

হরমোনের কাজ কি?- What is the function of hormones?

হরমোনের কাজ সাধারণত মানবদেহের বিভিন্ন ধরণের গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া পরিচালনা করা, যেমন মানসিক স্বাস্থ্য, শারীরিক বৃদ্ধি, প্রজনন এবং বিপাকীয় কর্মকাণ্ড। নিম্নে বিশেষ কিছু হরমোন এবং তাদের বিভিন্ন কার্যক্রম সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হল। দেখি তাহলে চলুন- 

ইনিস্যুলিন- insulin

  • উৎপত্তিস্থল- ইনস্যুলিন উৎপত্তি হয় অগ্ন্যাশয়ের বিটা কোষ থেকে।
  • কাজ- রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে ইনস্যুলিন। এটি গ্লুকোজকে সাহায্য করে কোষে প্রবেশ করতে, যাতে কোষ শক্তি উৎপাদন করতে পারে। কারণ, রক্তে গ্লুকোজ বেড়ে যায়, ইনস্যুলিন ঘাটতি হলে।

থাইরক্সিন- Thyroxine

  • উৎপত্তিস্থলথাইরক্সিন উৎপত্তি হয় থায়রয়েড গ্রন্থি থেকে।
  • কাজ- এটি নিয়ন্ত্রণ করে শরীরের বিপাকীয় হার। তাছাড়া, শরীরের তাপমাত্রা ও শক্তি উৎপাদনে সাহায্য করে, যাতে কোষগুলো সঠিকভাবে কাজ করতে পারে।

অ্যাড্রেনালিন- Adrenaline

  • উৎপত্তিস্থল- এটির উৎপত্তি হয় অ্যাড্রেনালিন গ্রন্থি থেকে।
  • কাজ-  অ্যাড্রেনালিন মূলত ফাইট বা ফ্লাইট প্রতিক্রিয়া তৈরী করে, হৃদস্পন্দন বৃদ্ধি করে, শ্বাসনালীকে সম্প্রসারণ করে এবং শক্তির উৎপাদনকে বাড়িয়ে শরীরকে দ্রুত কাজ করতে সাহায্য করে।

অক্সিটোনিস- Oxytonis

  • উৎপত্তিস্থল- এটির উৎপত্তি হয় পিটুইটারি গ্রন্থি থেকে।
  • কাজ- এটি মূলত সাহায্য করে গর্ভবতী মা- বোনদের প্রসবের সময় জরায়ু সংকুচিত করতে এবং দুধের উৎপাদন শুরু করতে। পাশাপাশি এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে মায়ের সঙ্গে সন্তানের সম্পর্ক গড়তে।

গ্রোথ হরমোন-- Growth Hormone 

  • উৎপত্তিস্থল- এটির উৎপত্তি হয় পিটুইটারি গ্রন্থি থেকে (Pituitary Gland), যা মস্তিস্কের নিচে অবস্থিত।
  • কাজ- এটি অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে শরীরের বৃদ্ধি এবং কোষের পুনঃনির্মাণে। শিশুর শারীরিক বৃদ্ধি যেমন- হাড়, পেশির উন্নতি এবং উচ্চতা সঠিকভাবে অর্জনে অত্যান্ত প্রয়োজনীয়। আর বয়স্কদের সাহায্য করে শরীরের মেটাবলিজম ও শক্তির উৎপাদন নিয়ন্ত্রণে।
তাছাড়া, গ্রোথ হরমোন শরীরে যথেষ্ট পরিমাণ থাকা জরুরি, কারণ এটির অভাব হলে বাধাগ্রস্থ হতে পারে শিশুর শারীরিক বৃদ্ধিতে। অপরদিকে বয়স্কদের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরণের শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে।

এস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন- Estrogen and progestin

  • উৎপত্তিস্থল- এটির উৎপত্তি হয় ডিম্বাশয় থেকে।
  • কাজ- নারীদের প্রজনন সিস্টেমকে নিয়ন্ত্রন করে এই হরমোনগুলো। এস্ট্রোজেন মহিলাদের জন্য, যেমন স্থন গঠন এবং নিয়ন্ত্রণ করে মাসিক চক্র। আর প্রোজেস্টেরন নারীদের গর্ভ ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশ তৈরি করে।

শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখার গুরুত্ব- The importance of maintaining body balance

মানুষের শরীরে জন্য অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ হরমোনের ভারসাম্য বজায় রাখা। হরমোনের মাত্রা কোন কারণে যদি কম বা বেশি হয়, তাহলে মানুষের শরীরে বিভিন্ন ধরণের শারীরিক এবং মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। এই বিষয়ে নিম্নে আলোচনা করা হলো-
** থাইরক্সিনের অভাব (হাইপোথাইরয়েডিজম)- এটি সেই সময় দেখা দেয়, যখন থাইরয়েড গ্রন্থি যথেষ্ট পরিমাণ উৎপাদনে ব্যর্থ হয়।
  • লক্ষণ- ওজন বেড়ে যায়, ক্লান্তি, অবসাদ, ঠান্ডা সহ্য করতে না পারা, মনোযোগের ঘাটতি ইত্যাদি।
  • অ্যাড্রেনালির অতিরিক্ত ক্ষরণ- সাধারণত অধিক স্ট্রেস বা আতঙ্কের সময় অ্যাড্রেনালির নিঃসৃত হয়।
  • প্রভাব- হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়, উদ্বেগ, ঘাম, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদি।
** গ্রোথ হরমোনের অভাব- এই হরমোনটি মূলত শরীরের বৃদ্ধি ও কোষের পুনঃগঠনের জন্য অত্যান্ত জরুরি।
  • সমস্যা- শিশুদের বেলায় বৃদ্ধি থেমে যায়, আর বয়স্কদের বেলায়, হাড় দুর্বল হওয়া এবং পেশির ভর কমে যায়।
** ইন্স্যুলিনের অভাব- ইনস্যুলিনের প্রধান কাজ রক্তে গ্লুকোজের মাত্রে নিয়ন্ত্রণ করা।
  • সমস্যা- হতে পারে টাইপ ১ ডায়াবেটিস এবং টাইপ ২ তেও ইনস্যুলিন প্রতিরোধ দেখা দেয়।

মানব জীবনে হরমোনের ভুমিকা- The role of hormones in human life

মানব দেহের প্রধান নিয়ন্ত্রক হিসাবে হরমোন কাজ করে, যা জীবনের বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা এবং শরীরের অভ্যান্তরীন ভারসাম্য বজায় রাখে। এদের অনুপস্থিতি বা অতিরিক্ত পরিমাণে ক্ষরণে হতে পারে অনেক রোগের লক্ষণ। এর চিকিৎসা সঠিক সময়ে না হলে, দীর্ঘ মেয়াদি সমস্যা হতে পারে।

হরমোনের প্রধান ভূমিকা কি?- শেষকথাঃ What is the main role of hormones? - Conclusion:

হরমোন হলো মানুষের শরীরের অনন্য এক অদৃশ্য নিয়ন্ত্রক শক্তি, যা শরীরের বৃদ্ধি, মানসিক অবস্থা, প্রজনন, বিপাকক্রিয়া এবং অভ্যান্তরীন পরিবেশ ঠিক রাখতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। সকল হরমোন এর নিজস্ব কাজ থাকলেও, সবার লক্ষ্য এক, শরীরকে সঠিকভাবে পরিচালনা করা। যেমন-
  • প্রজনন ও গর্ভধারণে সাহায্য করা।
  • শরীরের অভান্তরীন পরবেশ স্থিতিশীল রাখা।
  • বিপাক প্রক্রিয়া ও শক্তি উৎপাদন নিয়ন্তণ করা।
  • শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি ও বিকাসে সাহায্য করা।
  • আবেগ, মেজাজ ও মানসিক অবস্থার উপর প্রভাব ফেলা।
  • শরীরের রক্তে গ্লুকোজ ও অন্যান্য উপাদানের ভারসাম্য রখা।

এই সকল কারণে বলা হয়, হরমোন না থাকলে ব্যাহত হতো শরীরের স্বাভাবিক কার্যক্রম এবং আমরা করতে পারতামনা সুস্থ জীবন যাপন। সঠিক জীবনযাপন, পুষ্টিকর খাবার এবং প্রয়োজনীয় চিকিতসায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে হরমোনের ভারসাম্য।

প্রিয় পাঠক পাঠিকাগণ, আমরা আশাকরি আপনারা যদি আর্টিকেলটি মনোযোগের সঙ্গে পড়ে থাকেন, তাহলে নিশ্চয়ই জেনে গেছেন, "হরমোন কী? প্রকারভেদ, কাজ ও শরীরের উপর প্রভাব" সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য।

আরো পড়ুনঃ অ্যালার্জি হওয়ার লক্ষণ কি?- অ্যালার্জি প্রতিরোধের ঘরোয়া উপায়

আর্টিকেলটি যদি আপনাদের ভালোলাগে ও উপকারি বলে মনে হয়, তাহলে এটি অন্যের সঙ্গে শেয়ার করবেন, যাতে অন্যরাও উপকৃত হন। আরো নতুন নতুন তথ্য জানার জন্য আমাদের পরবর্তী আর্টিকেল পড়ুন এবং আমাদের সঙ্গে থাকুন, ধন্যবাদ।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url