মেয়েদের জরায়ু ক্যানসারের কারণ ও লক্ষণ কি?- জরায়ু ক্যানসারের চিকিৎসা ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা
মেয়েদের অত্যান্ত ঝুঁকিপূর্ণ এবং গুরুত্বপূর্ণ একটি স্বাস্থ্য সমস্যা জরায়ু ক্যানসার (Cervical Cancer), যেটি মূলত জরায়ুর সার্ভিক্সে বা গলদেশে হয়। এই সমস্যাটি একটি মেয়েদের প্রজনন অঙ্গের মারাত্নক রোগ, যা প্রতিরোধ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব সচেতনতা ও চিকিৎসার মাধ্যমে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)- এর তথ্য মতে, এই রোগে প্রতি বছর প্রায় ৬ লক্ষ নারী আক্রান্ত হন এবং মৃত্যু বরণ করেন প্রায় ৩ লক্ষ নারী। বিশেষ করে, এই সখ্যা উন্নয়নশীল দেশে বেশি, তাছাড়া সচেতনতা, স্ক্রিনিং প্রক্রিয়া বা টিকা এখনো সকলের নাগালের নেই।
আজকের আর্টিকেলে আমরা আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করবো, মেয়েদের জরায়ু ক্যানসার কী? এর কারণ, লক্ষণ, নির্ণয় পদ্ধতিসহ চিকিৎসা এবং এটি প্রতিরোধের উপায় সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য। তাহলে, চলুন আমরা দেখে নেই-
মেয়েদের জরায়ু ক্যানসার কি?
জরায়ু ক্যানসার বলতে সাধারণত জরায়ুর Cervix বা গলদেশে হওয়া একটি সমস্যা, যেটি থাকে জরায়ু এবং যোনির সংযোগস্থলে। পরবর্তী সময়ে এটি আস্তে আস্তে বেড়ে যায়, যা প্রথম দিকে এর উপসর্গ খুব একটা দেখা না গেলেও, পরে মারাত্নক আকার ধারণ করতে পারে। জরায়ু ক্যানসার মূলত দু'ই প্রকারের হতে পারে, যেমন-- স্কোয়ামাস সেল কার্সিনোমা (Squamous Cell Carcinoma)- এটি দেখা যায় প্রায় ৭০% থেকে ৮০% ক্ষেত্রে। এর উৎপত্তি হয়ে থাকে সার্ভিক্সের বাইরের স্তর থেকে।
- অ্যাদেনোকার্সিনোমা (Adenocarcinoma)- এর সংখ্যা অনেকটা কম হলেও বর্তমানে আস্তে আস্তে বাড়ছে। এটি উৎপন্ন হয় জরায়ুর গলদেশের গ্ল্যান্ডুলার কোস থেকে।
মেয়েদের জরায়ুর ক্যানসারের কারণ কি?
মেয়েদের জরায়ুতে বিভিন্ন কারণে ক্যানসার হতে পারে বা হয়ে থাকে। তবে, সাধারণত জরায়ুতে ক্যানসার হওয়ার জন্য নিম্নের কারণগুল সবচেয়ে বেশি দায়ী-
** সংক্রমণ Human Papillomavirus (HPV)- জরায়ু ক্যানসারের সবচেয়ে প্রধাণ এবং সাধারণ কারণ হল, সংক্রমণ HPV। জরায়ু ক্যানসারে আক্রান্ত নারীদের প্রায় ৯৯% নারীর শরীরে সংক্রমণ HPV ভাইরাস পাওয়া যায়।
এই ভাইরাসটি একটি যৌনবাহিত ভাইরাস এবং এর রয়েছে শতাধিক প্রকারভেদ, যেমন HPV- ১৬ ও HPV- ১৮ সবচেয়ে বিপদজনক। এগুলো পরিচিতি লাভ করেছে ক্যানসার সৃষ্টিকারি হিসাবে।
** অনিরাপদ যৌন সম্পর্ক- খুব কম বয়সে যৌন জীবন শুরু করা, বিভিন্ন জনের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন এবং যৌন মিলনের সময় কনডম ব্যবহার না করার কারণে, HPV সংক্রমণের ঝুকি অত্যান্ত বেড়ে যায়। ফলে সম্ভবনা বেড়ে যায় জরায়ু ক্যানসারের।
** সংক্রমণ Human Papillomavirus (HPV)- জরায়ু ক্যানসারের সবচেয়ে প্রধাণ এবং সাধারণ কারণ হল, সংক্রমণ HPV। জরায়ু ক্যানসারে আক্রান্ত নারীদের প্রায় ৯৯% নারীর শরীরে সংক্রমণ HPV ভাইরাস পাওয়া যায়।
এই ভাইরাসটি একটি যৌনবাহিত ভাইরাস এবং এর রয়েছে শতাধিক প্রকারভেদ, যেমন HPV- ১৬ ও HPV- ১৮ সবচেয়ে বিপদজনক। এগুলো পরিচিতি লাভ করেছে ক্যানসার সৃষ্টিকারি হিসাবে।
** অনিরাপদ যৌন সম্পর্ক- খুব কম বয়সে যৌন জীবন শুরু করা, বিভিন্ন জনের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন এবং যৌন মিলনের সময় কনডম ব্যবহার না করার কারণে, HPV সংক্রমণের ঝুকি অত্যান্ত বেড়ে যায়। ফলে সম্ভবনা বেড়ে যায় জরায়ু ক্যানসারের।
** ধুমপান- রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমার পেছনে অনেকটা দায়ী ধূমপান। কারণ ধূমপানের কারণে মানুষের শরীরের কোষে কমে যায় টক্সিন উৎপাদন, এতে কোষ বেড়ে যেতে পারে অসবাভাবিক হারে।
** দীর্ঘদিন জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি সেবন- একটি গবেষণায় উঠে এসেছে যে, যারা দীর্ঘদিন ধরে জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি সেবন করেন, তাদের জরায়ু ক্যানসারের ঝুকি অনেক বেড়ে যায়। তবে, এটি সেরে যায় বড়ি খাওয়া ছেড়ে দিলে।
** রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দূরবল- অনেকের ইমিউন সিস্টেম অনেক দূরবল (বিশেষ করে HPV পজেটিভ যাদের) তারা, HPV ভাইরাস থেকে নিজেকে সুরক্ষা করতে পারেন না। ফলে তাদের ক্যানসার আক্রন্ত হওয়ার সম্ভবনা বেড়ে যায়।
** পারিবারিক ভাবে- আপনার পরিবারের কেউ যদি পূর্বে জুরায়ু ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে থাকেন, সেক্ষেত্রে আপনারও এই রোগে আক্রন্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়।
মেয়েদের জরায়ু ক্যানসারের লক্ষণ কি?
জরায়ু ক্যানসারের লক্ষণ প্রথম দিকে নির্ণয় করা অনেক কঠিন, কারণ প্রাথমিক অবস্থায় এটি কোন উপসর্গ সৃষ্টি করে না। তাইতো ক্যানসারকে বল হয় "নিরব ঘাতক"। কিন্তু এটি অল্প একটু অগ্রসর হলেই নিম্নের লক্ষণগুলো দেখা যায়। যেমন-
- মাসিক ছাড়াও রক্তপাত, বিশেষ করে যৌন মিলনের পর।
- মাসিক চলাকালে অতিরিক্ত রক্তপাত হওয়া।
- ওজন কমা, ক্ষুধামন্দা এবং দুর্বলতা।
- যৌনপথ থেকে দুর্গন্ধজুক্ত স্রাব।
- যৌনমিলনে অস্বস্তি বা ব্যথা।
- কোমর বা তলপেট ব্যথা।
- মুত্রত্যাগে রক্ত ও ব্যথা।
উপরের যে কোন ধরনের উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
জরায়ু ক্যানসার রোগ নির্ণয় পদ্ধতি
*** Pop Smear Test- এই পদ্ধতিটি খুবই কার্যকর ও সাধারণ স্ক্রিনিং টেস্ট। এতে জরায়ুর গলদেশ থেকে কোষ সংগ্রহ করে পাঠানো হয় পরীক্ষাগারে, এর মাধ্যমে নির্ণয় করে দেখা হয়, কোষে কোন পরিবর্তন আছে কিনা।
** HPV DNA Test- এই টেস্টের মাধ্যমে দেখা হয়, শরীরে কোন উচ্চ মাত্রার HPV আছে কি না। এটি Pap smear এর সঙ্গে করা যেতে পারে।
** কোলপোস্কোপি (Colposcopy)- যদি Pap smear পরীক্ষায় যদি কোন অস্বাভাবিকতা ধরা পড়ে, তবে জরায়ুর গলদেশকে বড় করে দেখার পর, সন্দহজনক কোষ চিহ্নিত করার জন্য করা হয় কোলপোস্কোপি।
** বায়োপসি (Biopsy)- ক্যানসারের কোষ আছে কিনা সেটি নির্ণয় করার জন্য, সন্দেহজনক টিস্যু সংগ্রহ করা হয়। এটি সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পরীক্ষা এবং চুড়ান্ত পদ্ধতি।
জরায়ু ক্যানসার রোগের চিকিৎসা পদ্ধতি
জরায়ু রোগের চিকিৎসা রোগের ধরণ এবং ধাপ অনুজায়ি আলাদা আলাদা হয়ে থাকে। নিম্নে চিকিৎসা পদ্ধতি দেখুন-
** অস্ত্রোপাচার (Surgery)- প্রাথমিক অবস্থায় যদি, ক্যানসার ধরা পড়ে, তাহলে জরায়ু বা সার্ভিক্স পুরোটাই অপসারণ (হিস্টেরেকটোমি) করার মাধ্যমে ক্যানসার মুক্ত করা যায়।
** রেডিওথেরাপি (Radiotherapy)- ক্যানসারের কোষ ধবংস করা হয় রেডিয়েশনের মাধ্যমে। এটি করা হয় কেমোথেরাপির সঙ্গে মিলে।
** কেমোথেরাপি (Chemotherapy)- ওষুধ দেওয়া হয় ক্যানসের কোষ ধবংস করার জন্য। এই ব্যবস্থাটি মূলত প্রয়োগ করা হয় অগ্রসর ধাপে।
** ইমিউনোথেরাপি ও টার্গেটেড থেরাপি- উন্নত ধরণের চিকিৎসা হিসাবে শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে সক্রিয় করার মাধ্যমে, ক্যানসারের কোষের বিরুদ্ধে লড়াই করানো হয়।
জরায়ু ক্যানসার রোগ প্রতিরোধের উপায়
রোগে আক্রান্ত হওয়ার আগে, রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। কথায় আছে "প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ করা" উত্তম। এই রোগ প্রতিরোধে নিম্নের পদক্ষেপ গ্রহন করা যেতে পারে। চলুন দেখি প্রতিরোধ ব্যবস্থাগুলো-
*** HPV টিকা- Gardasil ও Cervarix- এই টিকা ৯-১২ বছর বয়সী মেয়েদের দেওয়া হয়। এগুলো ক্যানসারের কোষ সৃষ্টিকারী HPV ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সক্ষম। অনেক দেশে এখন এটিকে জাতীয় টিকাদান কর্মসূচীর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
*** নিয়মিতভাবে স্ক্রিনিং- ২১ বছর বয়সের পর থেকে নিয়মিতভাবে প্রতি ৩ বছর পর পর Pap smear টেস্ট করা জরুরি এবং ৩০ বছর পার হলে HPV টেস্টও এর অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।
*** সু-রক্ষিত যৌন সম্পর্ক স্থাপন- যৌন সম্পর্কের সময় যদি, কনডম ব্যবহার করা হয়, তাহলে অনেকটাই কমে যায় HPV সংক্রমণের ঝুকি।
*** সবাস্থ্যকর জীবনযাপন- নিয়মিত ব্যায়ামের পাশাপাশি সুসম খাদ্যাভাস এবং মানসিক চাপমুক্ত জীবন ক্যানসার প্রতিরোধে সাহায্য করে।
*** ধূমপানকে বর্জন- ধূমপান ক্যানসারের ঝুকি বাড়ায়, তাই ধূমপান বর্জন করা উচিৎ।
জরায়ু ক্যানসার প্রতিরোধের উপায়- শেষকথা
জরায়ু ক্যানসার প্রতিরোধযোগ্য এবং চিকিৎসাযোগ্য রোগ। যদি সঠিক সময়ে স্ক্রিনিং, HPV টিকা এবং সচেতনতার মাধ্যমে এই রোগ কমিয়ে আনা সম্ভব। বিশেষ করে নারীদের সঠিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও নিজেদের সচেতন রাখা, যেন শুরুতেই রোগটি ধরা পড়ে এবং সঠিকভাবে চিকিৎসা করা যায়।
তাছাড়া, যদি সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে যৌথভাবে অংশ গ্রহণ করা যায় সচেতনতামূলক কার্যক্রমে, তাহলে ভবিষ্যতে মারাত্নক এই রোগকে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। একজন সচেতন নারী মানেই, সচেতন একটি পরিবার এবং সুস্থ সমাজ।
প্রিয় পাঠক পাঠিকাগণ, আমরা আশাকরি আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করতে পেরেছে, মেয়েদের জরায়ু ক্যানসার কী? এর কারণ, লক্ষণ, নির্ণয় পদ্ধতিসহ চিকিৎসা এবং এটি প্রতিরোধের উপায় সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য। যা আপনাদের অনেক উপকারে আসবে বলে আমরা আশাবাদী।
আর্টিকেলটি যদি আপনাদের ভালোলাগে এবং উপকারি বলে মনে হয়, তাহলে এটি অন্যের সঙ্গে শেয়ার করবেন, যেন অন্যরাও উপকৃত হন। আরো নতুন নতুন তথ্য জানার জন্য আমাদের পরবর্তী আর্টিকেল পড়ুন এবং আমাদের সঙ্গে থাকুন, ধন্যবাদ।
এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url