কালোজিরার পুষ্টি উপাদান উপকারিতা ও অপকারিতা

কালোজিরা ছোট একটি কালো বিজ (এটি Nigella Stiva নামেও পরিচিত), যা ব্যবহার হয়ে থাকে বিভিন্ন স্বাস্থ্য উপকারিতার জন্য। কালো জিরার আদি জন্মস্থান দক্ষিণ- পশ্চিম এশিয়াতে, তবে এখন এটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পরিচিত এবং ব্যবহৃত হয়।
কালোজিরার বীজ ও তেল আয়ুর্বেদিক এবং ইউনানি চিকিৎসায় বহুল প্রচলিত রয়েছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বিশেষ করে ভারত, পাকিস্তান, মিশর এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশে। কালোজিরা তার বিভিন্ন উপকারিতা ও বিভিন্নগুণে পরিপূর্ণ, যা প্রাচীন কাল থেকেই বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় ব্যবহার হচ্ছে।
এতে রয়েছে, শক্তিশালী বিভিন্ন গুণাবলী, যেমন অ্যান্টি অক্সিডেন্ট, অ্যান্টি ব্যাকটেরিয়াল, অ্যান্টি ইনফ্লেমেটিরি এবং অ্যান্টি ভাইরাল। তাছাড়া, এতে থাকা থাইমোকুইনোন কম্পাউন্ড গুণাবলী, যা কালোজিরাকে করে তুলেছে আরো পরিচিত।
তবে, কালোজিরার যেমন রয়েছে অনেক উপকারি গুণাগুণ, তেমনি এর কিছু অপকারিতাও রয়েছে, তাই এটি সম্পর্কে ভালোকরে জানা উচিৎ। চলুন তাহলে দেখে নেওয়া যাক, কালোজিরার পুষ্টি ইপাদান, উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সম্পর্কে- 

কালোজিরায় থাকা বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান- Various nutrients in black cumin

কালোজিরা বা Nigella Stiva ভেসজ জাতীয় পুষ্টিকর উপাদান, যা আমাদের শরীরে প্রচুর গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান সরবরাহ করে, যেগুলো শরীরে নানান ধরণের কার্যকলাপে সাহায্য করে। নিম্নের আলোচনা থেকে দেখে নেওয়া যাক কালোজিরায় থাকা বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান সম্পর্কে- 

থাইমোকুইনোন- Thymoquinone

কালোজিরায় পাওয়া যায় থাইমোকুইনোন নামক একটি শক্তিশালী অ্যান্টি অক্সিডেন্ট, যা সাহায্য করে প্রদাহ কমাতে এবং সেলুলার ক্ষতি রোধে। কালোজিরার মূল কার্যকরী উপাদান এটি, যা শরীরের বিভিন্ন রোগের বিরেদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।

প্রোটিন- protein

কালোজিরায় রয়েছে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন, যা শরীরের কোষ গঠিনের পাশাপাশি, শরীর মেরামতের জন্য প্রচুর ভূমিকা পালন করে। তাছাড়া, এটি শরীরের শক্তি বৃদ্ধিতে সাহায্য করে এবং পেশী গঠনে ভুমিকা পালন করে।

ফ্যাটি অ্যাসিড- Essential Fatty Acids

কালোজিয়ায় রয়েছে বিভিন্ন ফ্যাটি অ্যাসিড। যেমন- 
  • ওমেগা-৩ ঃ মস্তিস্কের কার্যক্রম উন্নত করতে এবং হৃদরোগের ঝুকি কমাতে সাহায্য করে।
  • ওমেগা- ৬ঃ এটি ইনফ্ল্যামেশন কমানো সঙ্গে চুল ও ত্বকের জন্য উপকারি।

ভিটামিন- vitamins

কালোজিরায় পাওয়া যায় বিভিন্ন ধরণের ভিটামিন। যেমন-
  • ভিটামিন A- এটি ত্বক ও চুলের স্বাস্থ্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।
  • ভিটামিন B- কালোজিরায় রয়েছে, ভিটামিন B1, B2, B3, B5 যা, শরীরের শক্তি উপাদান এবং সাহায্য করে স্নায়ুর কার্যক্রম বজায় রাখতে।
  • ভিটামিন C-  এটি অন্যতম একটি শক্তিশালী অ্যান্টি অক্সিডেন্ট, যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে।

খনিজ- minerals

অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খনিজ উপাদান রয়েছে কালোজিরায়, যেমন- 
  • ফসফরাস- হাড় এবং দাতের স্বাস্থ্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।
  • আয়রন- রক্ত সল্পতা প্রিতিরোধে সহায়ক।
  • ক্যালসিয়াম- শক্তিশালী হাড় গঠন করতে এবং মাংসপেশির কাজ করতে সাহায্য করে।
  • পটাশিয়াম- রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ এবং হৃদপিণ্ডের কার্যক্রমকে সঠিক রাখে।

ফাইবার- fiber

কালোজিরায় পাওয়া যায় উচ্চমাত্রার ফাইবার, যা উন্নত করে পাচন প্রক্রিয়াকে, কোষ্টকাঠিন্য, পেটের অশান্তিসহ গ্যাসের সমস্যা সমাধান করে।

অ্যান্টি অক্সিডেন্ট- Anti-oxidant

অ্যান্টি অক্সিডেন্টে ভরপুর থাকে কালোজিরায়, যা শরীরের কোষগুলোকে মুক্ত র্যাডিকেলসের হাত থেকে রক্ষা করে এবং শরীরের প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে।

মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টস- Micronutrients

কালোজিরায় পাওয়া যায় মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট যেমন, ম্যাগ্নেসিয়াম, সেলেনিয়াম এবং জিঙ্ক, যা শরীরের বিভিন্ন জৈবিক প্রক্রিয়া, যথা স্নায়ুতন্ত্রের কার্যক্রম, ভারসাম্য রাখে হরমোনের এবং কোষকে পুনর্গঠনে সাহায্য করে।

কালোজিরা খাওয়ার উপকারিতা- Benefits of eating black cumin

কালোজিরাকে শুধুমাত্র ভেষজ উপাদান নয় বরং এটিকে বলা যায় এক ধরণের পুষ্টির ভাণ্ডার। এতে যে সকল পুষ্টি উপাদান পাওয়া যায়, তা শরীরের জন্য অত্যান্ত উপকারি, যেমন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো, হৃদরোগ প্রতিরোধ করে, হজম শক্তি উন্নত করে এবং ত্বক ও চুলের স্বাস্থ্য বজায় রাখে। 
তবে, কালোজিরার যেহেতু কিছু অপকারিতা রয়েছে, তাই এটি ব্যবহার বা খাওয়ার আগে সঠিক পরিমাণ এবং উপায় জানা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। যাতে এর সর্বাধিক উপকারিতা পাওয়া যায়। নিম্নে কালোজিরার গুরুত্বপূর্ণ উপকারিতা সম্পর্কে আলোচনা করা হলো- 
*** ইমিউন সিস্টেম উন্নতি- বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমাতা বাড়াতে সাহায্য করে কালোজিরা। কারণ, এতে পাওয়া যায় থাইমোকুইনোন এবং বিভিন্ন অ্যান্টি অক্সিডেন্ট উপাদান। যা শরীরে থাকা বিভিন্ন খারাপ জীবাণুর বিরুদ্ধে কাজ করে।
*** হজম প্রক্রিয়া ও পাচন শক্রি বাড়ায়- খাবারকে দ্রুত হজমে সাহায্য করে কালোজিরা। যেমন পেট ব্যথা, গ্যাস, অস্বস্তি কোষ্ঠকাঠিন্য ইত্যাদি সমস্যার সমাধান করে। তাছাড়া, পেটের প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে, এতে থাকা অ্যান্টি ইনফ্লেমেটরী গুণাগুণ।
*** নিয়ন্ত্রণ করে ব্লাড সুগার- ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য এটি অত্যান্ত উপকারি। কারণ, এটি যেমন রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণ করে, তেমনি সাহায্য করে ইনস্যুলিনের সংবেদনশীলতা বৃদ্ধিতে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায় কালোজিরা খেলে কমতে পারে রক্তের শর্করার মাত্রা।
*** হৃদরোগ প্রতিরোধ করে- কালোজিরা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করার সঙ্গে সঙ্গে রক্তের কলেস্টেরল এর মাত্রাকে কমিয়ে হার্টকে সুরক্ষা করতে সাহায্য করে। এটিকে হৃদযন্ত্রের জন্য এক ধরণের প্রাকৃতিক সুরক্ষা বলা যেতে পারে।
*** র্থ্রাইটিসের ব্যথা কমায়- অ্যান্টি ইনফ্লেমেটরি গুণ কালোজিরায় রয়েছে, যা র্থ্রাইটিসের ব্যথা এবং বাতের কারণে সৃষ্টি হয়া ব্যথা ও প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে। অনেকে আছেন যারা কালোজিরার তেল ব্যবহার করেন জয়েন্টের প্রদাহ ও মাংসপেশির ব্যথা কমাতে।
*** মস্তিস্কের কার্যক্রম ও মানসিক সুস্থতা- কালোজিরার তেল মস্তিস্কের কার্যক্রম বাড়ানোর পাশাপাশি মানসিক চাপ, আবসাদ এবং উদ্বেগ কমাতে সাহায্য করে। তাছাড়া, এতে থাকা থাইমোকুইনোন, সাহায্য করে মস্তিস্কের সঠিক প্রক্রিয়া বজায় রাখতে।
*** ত্বক ও চুলের জন্য উপকারি- ত্বক ও চুলের জন্য খুবই উপকারে কালোজিরার তেল। এটি ত্বকের রুক্ষতা, অ্যাকনে, ব্রণের সমস্যা কমাতে সাহায্য করে এবং চুলের গতি এবং স্বাস্থ্য বৃদ্ধি করে। তাছাড়া, এটি খুসকি ও চুল পড়া বন্ধ করে।

কালোজিরা খাওয়ার অপকারিতা- Disadvantages of eating black cumin

** রক্তের সমস্যা-  কালোজিরা রক্ত পাতলা করতে সাহায্য করে, তাই এটি ব্যবহারের সময় আপনি যদি রক্তজনিত সমস্যা বা অস্ত্রোপাচারের কথা ভাবেন, তবে সাবধানতা অবলম্বন করা উচিৎ। তাছাড়া, রক্তপাত নিয়ন্ত্রণের থাকা ওষুধের সঙ্গে এটি খাওয়া উচিৎ নয়। 
** গর্ভকালীন সময়ে- গর্ভকালীন সময়ে কালোজিরা খাওয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা উচিৎ। কারণ অতিরিক্ত কালোজিরা গর্ভের জন্য ক্ষতিকর, কারণ এটি জরায়ুর সংকোচন বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। সে কারণে, এটি গর্ভকালীন সময়ে খাওয়ার ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করা উচিৎ।
** অ্যালার্জির সমস্যা- কালোজিরা এবং এর তেলে অনেকের অ্যালার্জির সমস্যা থাকতে পারে। যা শ্বাসকষ্ট, ত্বকে র‍্যাশ বা অন্যান্য সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। তাই আপনি যদি আগে কখনো এটি ব্যবহার না করে থাকেন, তবে প্রথমবার ব্যবহারে সতর্ক থাকা উচিৎ।
** নিম্ন রক্তচাপ- কালোজিরা যেহেতু রক্ত কমায়, তাই এটি অতিরিক্ত ব্যবহার করা উচিৎ নয়, কারণ এটি ব্যবহারে রক্তচাপ অনেক কমে যেতে পারে। বিশেষ করে যারা উচ্চ রক্তচাপের অসুধ ইতিমধ্যেই খাচ্ছেন, তাদের জন্য এটি হতে পারে বিপদজনক।
** গ্যাস্টিকের সমস্যা- অধিক পরিমাণে কালোজিরা খাওয়ার কারণে পেটে অম্লতা, গ্যাস এবং হজমের সমস্যা হতে পারে, তাই এটি পরিমাণমকত খাওয়া উচিৎ।

কালোজিরা খাওয়ার সঠিক নিয়ম- The correct way to eat black cumin seeds

কালোজিরা বা Cuminum cyminum খাওয়ার নিয়ম অনেক সহজ এবং যা স্বাস্থ্যকর। সাধারণত কালোজিরা পাচনতন্ত্রের স্বাস্থ্য ভালো রাখার পাশাপাশি বিভিন্ন রোগের প্রতিকারক হিসাবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। নিম্নে কালোজিরা খাওয়ার সঠিক নিয়ম সম্পর্কে জানুন-
  • আপনি প্রতিদিন ১ চা চামচ করে কালোজিরা বা এর পূর্ণ গুড়া খেতে পারেন।
  • কোনভাবেই কালোজিরা অতিরিক্ত খাওয়া উচিৎ নয়, এটি গ্যাস সৃষ্টি করতে পারে।
  • কালোজিরা সরাসরি খাওয়ার পাশাপাশি মধুর সঙ্গে পানিতে ভিজিয়ে খাওয়া যেতে পারে।
  • কালোজিরা মধুর সঙ্গে মশিয়ে খাওয়ার কারণে, হজমের বিভিন্ন সমস্যা দূর করতে সাহায্য করে।
  • কালোজিরা গরম পানির সঙ্গে মিশিয়ে নিয়মিত পান করলে শ্বাসকষ্ট ও হাঁচি কাশি কমাতে সাহায্য করে।

ইসলাম ধর্মে কালোজিরা খাওয়ার গুরুত্ব- The importance of eating black cumin in Islam

ইসলাম ধর্মে কালোজিরা বা নিগেলা সাটিভা সেবনের গুরুত্ব অনেক বেশি। হাদিস শরীফে এসেছে, কালোজিরা একটি আশীর্বাদ স্বরূপ ওষুধ, যা সুস্থ্য রাখে শরীর এবং মনকে। হাদিস মতে কালোজিরা অনেক রোগের চিকিৎসায় ব্যবহার করা যায়।
রাসুলে পাক (সাঃ) বলেছেন, "কালোজিরা সর্বরোগের মহা ঔষধ, তবে মৃত্যু ছাড়া (শহীহ বুখারী)। এটি একটি প্রাকৃতিক অ্যান্টি ইনফ্লেমেটরি, অ্যান্টি অক্সিডেন্ট, যা বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে থাকে।
কালোজিরার তেলে পাওয়া যায়, বিভিন্ন ধরণের ভিটামিন, খনিজ এবং অনুবীক্ষণিক উপাদান, যা শরীরের অসুস্থতা দূর করে এবং সুস্থ্যতা বজায় রাখতে সাহায্য করে। তাই, ইসলাম ধর্মে কালোজিরা খাওয়ার ব্যপারে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

মৃত্যু ছাড়া সকল রোগের মহাঔষধ- শেষকথাঃ The ultimate cure for all diseases except death

কালোজিরা অত্যান্ত উপকারি একটি ভেষজ উপাদান, তবে এটি সঠিক ব্যবহারের জন্য অনেকটা সতর্কতা অবলম্বন করা উচিৎ। কারণ, এর স্বাস্থ্য উপকারিতা অনেক থাকলেও, অতিরিক্ত বা ভুলভাবে ব্যবহার করলে কিছু পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হতে পারে।
সে কারণে, কালোজিরা খাওয়ার আগে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে আপনি যদি চিকিৎসা নেন বা গর্ভবর্তী হয়ে থাকেন। ইসলাম ধর্ম অনুসারে "মৃত্যু ছাড়া সকল রোগের মহাঔষধ কালোজিরা"।
প্রিয় পাঠক পাঠিকাগণ, আমরা আশাকরি আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করতে পেরেছি, "কালোজিরার পুষ্টি উপাদান উপকারিতা ও অপকারিতা''সহ বিভিন্ন তথ্য। যা, আপনাদের অনেক উপকারে আসবে বলে আমরা অনেক আশাবাদী।
আর্টিকেলটি যদি আপনাদের ভালোলাগে ও উপকারি বলে মনে হয়, তাহলে এটি অন্যের সঙ্গে শেয়ার করবেন। আরো নতুন নতুন তথ্য জানার জন্য আমাদের পরবর্তী আর্টিকেল পড়ুন এবং আমাদের সঙ্গে থাকুন, ধন্যবাদ।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url