বান্ধ্যত্ব রোগ কি? কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা ব্যবস্থা
আরো পড়ুনঃ হরমোন মানুষের দেহের গোপন নিয়ন্ত্রক- হরমোন কী?
বান্ধ্যত্ব মানুষের এমন এক ধরণের শারীরিক সমস্যা, যার কারণে কোন নারী বা পুরুষ সন্তান জন্ম দানে অক্ষম হয়। এটি যদিও সাধারণ একটি সমস্যা, কিন্তু এটি মানসিক ও শারীরিক গভীরভাবে প্রবাব ফেলে, যা অনেক দম্পত্তির জন্য খুবই কষ্টকর।
তবে, আশার কথা হলো সম্প্রতিক সময়ে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান এবং তথ্য প্রযুক্তির সাহায্যে এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হচ্ছে। তবে, শারীরিক ও মানসিক উপায়ে এই সমস্যার সমাধান করা জরুরী। আজকের আলোচনায় আপনাদের সঙ্গে এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
বান্ধ্যত্ব রোগ কি?- What is infertility disease?
বান্ধ্যত্ব হলো এমন বিশেষ এক ধরণের সমস্যা, যেখানে একটি যুগল বা দম্পত্তি এক বছর বা তার চেয়ে অধিক সময় ধরে নিয়মিতভাবে শারীরিক সম্পর্ক বা সহবাস করেও, সন্তান জন্ম দিতে পারে না। এই রোগটি কেবল মাত্র নারীদের ক্ষেত্রে নয়, পুরুষের মধ্যেও দেখা যায়।
তবে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) মনে করেন, যদি কোন মহিলা এক বছর ধরে মেলামেশা বা সহবাস করেও, গর্ভ ধারণের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে থাকেন, তাহলে তাকে বান্ধ্যত্ব রোগ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে।
বান্ধ্যত্ব রোগের কারণ কি?- What causes infertility?
বান্ধ্যত্ব রোগটি হওয়ার জন্য বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে, যা নারীদের
ও পুরুষের ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। তবে, এর সঠিক কারণ চিহ্নিত করা অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি সম্পূর্ণ নির্ভর করতে হয় চিকিৎসার উপর। তবে, নিম্নে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ আলোচনা করা হলো-
নারীদের বান্ধ্যত্বের কারণ- Causes of female infertility
*** ডিম্বাণু উৎপাদন সমস্যা (Ovulation Disorders)- নারীদের
বান্ধ্যত্বের জন্য এই কারণটি অন্যতম প্রধান কারণ। পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম (PCOS) বা অন্য যে কোন হরমোনাল সমস্যা থাকলে ডিম্বাণু উৎপাদনে সমস্যা হয়, এর কারণে গর্ভধারণে সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে।
*** এন্ড্রোমেট্রিওসিস (Endometriosis)- এটি একটি শারীরিক অবস্থা, যেখানে
বেড়ে যায় জরায়ুর বাইরের টিস্যু, যা ক্ষতি করতে পারে গর্ভধারণে। কারণ,
এন্ড্রোমেট্রিওসিসের ফলে বাধা সৃষ্টি হয় শুক্রাণুর চলাচলে, এতে গর্ভধারণে সমস্যা
হয়।
*** গর্ভশয়ের সমস্যা (Uterine abnormality)- অস্বাভাবিকতা জরায়ুর ভিতরে থাকলে (যেমন পলিপ বা ফাইব্রয়েড), তা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে গর্ভধারণে। আর এইসব সমস্যার কারণে গর্ভপাতও ঘটেতে পারে গর্ভ অবস্থার নির্দিষ্ট সময়ে।
*** ফ্যালোপিয়ান টিউব ব্লক (Blocked fallopian Tubes)- ফ্যালোপিয়ান
টিউব ব্লক বা বন্ধ হওয়ার কারণে সংযোগ
ঘটাতে পারে না, ডিম্বাণু ও শুক্রাণুর। এর ফলে গর্ভধারণ অসম্ভব হয়ে পড়ে।
*** বয়সজনিত কারণ (Age-related factors)- নারীদের বয়স সাধারণত ৩৫ বছর
অতিক্রম করলে, তাদের উর্বরতা কমতে থাকে। ডিম্বাণু উৎপাদন কম এবং হরমোনাল পরিবর্তনের কারণে, গর্ভধারণের সমস্যা হয়।
এছাড়াও, পলিসিস্টিক ওভারি সীন্ড্রোম (PCOS) বা অন্য কোন হরমোনাল
সমস্যার কারণে ডিম্বানু উৎপাদন ব্যঘাত ঘটে, এর ফলে গর্ভধারণে সমস্যা হতে পারে।
পুরুষদের বান্ধ্যত্বের কারণ- Causes of male infertility
*** শুক্রাণুর
সমস্যা বা গুণগত কারণ- পুরুষদের ক্ষেত্রে প্রাথমিক কারণ হিসাবে শুক্রাণুর গুণগত বা
পরিমাণ গত সমস্যা। শুক্রণুর সংখ্যা যদি কম থাকে বা গুণগত মান খারাপ থাকে, তবে
গর্ভধারণের সম্ভাবনা কমে যায়।
*** শুক্রনালী বন্ধ বা ব্লক (Blockage in Seminal Ducts)- সঠিক উপায়ে
পুরুষদের শুক্রাণু বের করতে না পারলে, এটি হতে পারে বান্ধ্যত্বের একটি কারণ। অনেক
সময় ব্লোকেজ বা অবরোধ সৃষ্টি হলে শুক্রাণু প্রবাহ সমস্যা হতে পারে।
*** হরমোন জনিত সমস্যা- বিভিন্ন হরমোনের সমস্যা বা টেস্টোস্টেরনের
ঘাটতির সমস্যা বাধা তৈরি করতে পারে পুরুষদের উর্বরতায়। আর এই সমস্যার কারণে শুক্রণুর উৎপাদনকে
প্রভাবিত করে।
*** যৌনরোগ (Sexually Transmitted Disease- STD)- যৌনরোগ যেমন
গনোরিয়া, ক্ল্যামাডিয়া ইত্যাদি রোগ শুক্রাণুর সংখ্যা বা গুণগত মান কমাতে পারে। আর
এই সমস্যাগুলির সমাধানে সঠিক চিকিৎসা না হলে উর্বরতা কমিয়ে দিতে পারে।
*** অধিক পরিমাণে মাদক ধুমপান বা অ্যালকোহল সেবন- এই ধরণের জীবন
ধারার কারণে, শুক্রাণুর অনেক ক্ষতি করতে পারে, ফলে সমস্যা হতে পারে গর্ভধারণে।
বান্ধ্যত্বের লক্ষণ কি- What are the symptoms of infertility?
বান্ধ্যত্বের
প্রথম ও প্রধান লক্ষণই হলো গর্ভধারণ করতে অক্ষমতা বা না পারা। তবে, অনেক ক্ষেত্রে
শারীরিক কিছু লক্ষণ দেখা দিতে পারে। নিম্নে নারী ও পুরুষের বান্ধ্যত্বের কিছু
সাধারণ লক্ষণ দেখুন-
নারীদের বান্ধ্যত্বের
লক্ষণ- Symptoms of infertility in women
- একাধিকবার গর্ভপাত হওয়া।
- মাসি অনিয়ম বা বন্ধ হয়ে যাওয়া।
- যৌন সম্পর্কের সময় ব্যথা অনুভব করা।
- মাসিকের সময় অতিরিক্ত রক্তপাত বা ব্যথা।
পুরুষদের বান্ধ্যত্বের
লক্ষণ- Symptoms of male infertility
- বীর্যপাতের সময় সমস্যা।
- অণ্ডকোষে ব্যথা বা ফোলাভাব।
- শুক্রাণুর সংখ্যা বা গুণগত সমস্যা।
- ইরেক্টাইল ডিফ্র্যাংশন বা যৌন দুর্বলতা।
বান্ধ্যত্ব রোগের চিকিৎসা- Treatment of infertility
বান্ধ্যত্ব রোগের চিকিৎসা বিভিন্ন উপায়ে করা যেতে পারে। তবে, এটি নির্ভর করে বান্ধ্যত্ব রোগের কারণ ও সমস্যার উপর। নিম্নে কয়েকটি সাধারণ চিকিৎসা সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো-
স্বাস্থ্যকর জীবনজাপন করা- Living a healthy life
- ** পর্যাপ্ত বিশ্রয়াম ও ঘুম- পর্যাপ্ত বিশ্রয়াম ও ভালো ঘুম সাহাসাহায্য করে উর্বরতা বৃদ্ধি করতে।
- ** অতিরিক্ত ওজন নিয়ন্ত্রণ- ওজন বেড়ে যাওয়া বা মুটিয়ে যাওয়া উর্বরতার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে।
- ** মানিসিক চাপ- গর্ভধারণে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে মানসিক চাপ। তাই, চাপমুক্ত থাকার জন্য বিভিন্ন ব্যায়াম বা ধ্যান উপকারি হতে পারে।
- ** পুষ্টিকর খাদ্যা গ্রহনণ- স্বাস্থ্যকর খাবার গর্ভধারণে সাহায্য করে। তাই, পর্যাপ্ত মিটামিন, মিনারেল, প্রোটিন ও বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান বজায় রাখে শারীরিক সুস্থতা।
অসুধ ও চিকিৎসা গ্রহণ- Illness and treatment
সার্জিক্যাল চিকিৎসা- Surgical treatment
** এন্ডোমেট্রিওসিস বা ফাইব্রয়েড অপসারণ- জরায়ুর ফাইব্র্যয়েড বা বাইরের টিস্যু অপসারণের জন্য সার্জারি করা যেতে পারে।
** ফ্যালোপিয়ান টিউব খোলার অস্ত্রোপচার- টিউব যদি ব্লক হয়ে থাকে, তাহলে তা অস্ত্রোপচার করে খোলা যেতে পারে।
আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তা- Support of modern technology
- ** IUI (Intrauterine insemination)- এই পদ্ধতিতে নারীর গর্ভে শুক্রাণু সরাসরি প্রবেশ করানো হয়।
- ** ISCI (Intracytoplasmic Sperm Injection)- এই পদ্ধতিতে শুক্রাণু একটি ডিম্বাণুর ভিতরে ইনজেক্ট করা হয়।
- ** IVF (In-Vitro Fertilization)- এই পদ্ধতিতে শরীরের বাইরে ডিম্বাণু ও শুক্রাণু একত্রিত করা হয় এবং তা গর্ভে প্রতিস্থাপন করা হয়।
বান্ধ্যত্ব রোগের ঘরোয়া চিকিৎসা- Home treatment for infertility
বান্ধ্যত্ব রোগের ক্ষেত্রে ঘরোয়া কিছু চিকিৎসা সাহায্য করতে পারে। তবে, এটি কেবলমাত্র প্রাথমিক চিকিতসায় সাহায্য করতে পারে এবং এটি কোন চিকিৎসকের পরামর্শের বিকল্প নয়। কারণ, বান্ধ্যত্বের চিকিৎসায় সঠিকভাবে ডায়াগনোসিস এবং চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রহণ করা অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তবে, কিছু ঘরোয়া উপায় রয়েছে, যেগুলোর মাধ্যমে শরীরের উর্বরতা সাধারণভাবে বাড়ানো যেতে পারে বা বাড়াতে সাহায্য করে। নিচে কয়েকটি ঘরোয়া চিকিৎসার সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
- পুষ্টিকর খাদ্যাভাস।
- আদা ও দারুচিনি।
- তিল এবং মধু।
- আখরোট।
- মিস্টি আলু।
- তেজপাতা ও লবঙ্গ।
- উপকারি তেল।
- মানসিক চাপ কমানো।
- পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান।
- যৌনস্বাস্থ্য বজায় রাখা।
বান্ধ্যত্ব রোগের ঘরোয়া চিকিৎসা সতর্কতা- Home treatment precautions for infertility
আমাদের স্মরণ রাখতে হবে, ঘরোয়া চিকিৎসা কোন চিকিৎসার বিকল্প নয়। যদি, দীর্ঘ সময় গর্ভধারণে সমস্য হয়, তাহলে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সাহায্য নেওয়া জরুরি। কারণ, ঘরোয়া উপায়গুলো কেবলমাত্র সাধারণ স্বাস্থ্যসেবা সহায়তা মূলক হতে পারে।
তবে, ঘরোয়া উপায়গুলো অনেক সময় সাহায্য করতে পারে, কিন্তু গর্ভ ধারণের জন্য বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের চিকিৎসা গ্রহণ করা উচিত।
বান্ধ্যত্ব রোগ ও প্রতিকার- শেষকথাঃ Infertility Diseases and Remedies
বান্ধ্যত্ব রোগ কোন অভিশাপ নয়। এই রোগটি একটি চিকিৎসাযোগ্য শারীরিক একটি সমস্যা এবং বর্তমান আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে সফলভাবে গর্ভধারণ করা অনেক সম্ভব। তাই, চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া এবং মানসিকভাবে দৃঢ় থাকা অন্ত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ।
প্রিয় পাঠক পাঠিকাগণ, আমরা আশাকরি আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করতে পেরেছি, "বান্ধ্যত্ব রোগ কি? লক্ষণ, কারণ এবং চিকিৎসা" সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। যা আপনাদের অনেক উপকারে আসবে বলে আমরা অনেক আশাবাদী।
আরো পড়ুনঃ পাইলসের কারণ, লক্ষণ, এবং প্রতিরোধের ঘরোয়া উপায়
আর্টিকেলটি যদি আপনাদের ভালোলাগে এবং উপকারি বলে মনে হয়, তাহলে এটি অন্যের সঙ্গে শেয়ার করবেন, যাতে অন্যরাও উপকৃত হন। আরো নতুন নতুন তথ্য যানার জন্য আমাদের পরবর্তী আর্টিকেলটি পড়ুন এবং আমাদের সঙ্গে থাকুন, ধন্যবাদ।
এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url