মাশরুমের পুষ্টিগুণ, উপকারিতা, নিরাপদ মাশরুম চেনার উপায় ও জনপ্রিয় রেসিপি

আরো পড়ুনঃ কালোজিরার পুষ্টি উপাদান উপকারিতা ও অপকারিতা

মাশরুম একটি ছত্রাক জাতীয় পুষ্টিকর ও ঔষধীগুণে ভরপুর ফাঙ্গাস, যা সারা বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় খাবার। উপকারি ও জনপ্রিয় খাবারটি প্রাকৃতিকভাবে বা চাষের মাধ্যমে পাওয়া যায় এবং নিরামিষ খাদ্য হিসাবে প্রোটিন ও অ্যান্টি অক্সিডেন্টের দারুন উৎস।

তবে, সঠিক উপায়ে চেনা এবং রান্না করা মাশরুম স্বাস্থ্যের জন্য অনেক উপকারি হলেও, অচেনা বা বিসাক্ত মাসরুম স্বাস্থ্যের জন্য হতে পারে বিপদজ্জনক। তাই, সচেতনভাবে মাসরুম বেচে নেওয়া ও খাওয়া জরুরী। আর আজকের আর্টিকেলে আমরা আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করবো, মাসরুম সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা।

মাশরুম কি?- What is a mushroom?

মাশরুম বা ছত্রাক বলতে একধরণের ফাঙ্গাস (Fungus) কে বুঝায়, যা সাধারণত জন্মে মৃত বা পচনশীল জৈব পদার্থের উপর। এখন পর্যন্ত সারা বিশ্বে প্রায় ১৪,০০০ প্রজাতির মাসরুমের সন্ধান পাওয়া গেছে, তারমধ্যে শুধুমাত্র ৭০০ প্রজাতির মত মাশরুম মানুষের খাওয়ার উপযোগী।

অনেক মাশরুম রয়েছে, যেগুলো অত্যান্ত পুষ্টিকর ও ঔষধীগুণে ভরপুর, আবার অনেক মাশরুম রয়েছে, যেগুলো হতে পারে মানুষের জন্য বিষাক্ত এবং প্রাণঘাতী। মানুষ সাধারণত যে সকল মাশরুম খেয়ে থাকেন, সেগুলো চাষের মাধ্যমে উৎপাদন করা হয়। যেমন- অয়েস্টার মাশরুম, বাটন মাশরুম, শিটাকে মাশরুম, পোর্টোবেলো মাশরুম ইত্যাদি।

মাশরুম খাওয়ার স্বাস্থ্য উপকারিতা কি?- What are the health benefits of eating mushrooms?

মাশরুম মানুষের শরীরের জন্য বিভিন্নভাবে উপকার করে থাকে। তাইতো মাশরুমকে বলা হয়ে থাকে, "প্রাকৃতিক সুপারফুড"। নিম্নে মাশরুম খাওয়ার স্বাস্থ্য উপকারিতা সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো-

মাশরম- উচ্চমানের প্রোটিনের উৎস

মাশরুমে পাওয়া যায় উচ্চমানের প্রোটিন, যা নিরামিষভোজীদের জন্য অত্যান্ত উপকারী। মাশরুম শরীরের বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি শরীরের কোষ গঠন ও পেশী তৈরিতে সাহায্য করে।

মাশরুম- ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে

মাশরুমে যেমন ফ্যাট ও ক্যালোরি কম থাকে, কিন্তু ফাইবার ও পানি থাকে অনেক বেশি। তাই মাশরুম খেলে বেশি সময় পেট ভরা থাকে এবং অতিরিক্ত খাবার প্রবণতা কমে। ফলে ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।

মাশরুম- সমৃদ্ধ থাকে অ্যান্টি অক্সিডেন্টে

মাশরুমে পাওয়া যায় সেলেনিয়ামের মতো অ্যান্টি অক্সিডেন্ট, যা কোষের ক্ষয় প্রতিরোধ করে, বার্ধক্যকে করে বিলম্বিত এবং ক্যানসার রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে।

মাশরুম- শক্তিশালী করে ইমিউন সিস্টেম

মাশরুমে পাওয়া যায় প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন "ডি", সেলেনিয়াম এবং বিভিন্ন ধরণের বায়োঅ্যাকটিভ উপাদান, যা শরীরের প্রতিরক্ষা শক্তি বাড়াতে সাহায্য করে।

মাশরুম- ডায়াবেটিস নিয়নিয়ন্ত্রণে সাহায়ক

মাশরুমে যেমন ফাইবার বেশি থাকে, তেমনি গ্লাইসেমিক ইনডেক্স অনেক কম থাকে, যা রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।

মাশরুম- হৃদরোগ ও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করে

মাশরুমে পাওয়া যায় বিটা গ্লুকান নামক বিশেষ এক ধরণের উপাদান, যা শরীরের কোলেস্টেরল কমায় এবং হ্রাস করে হৃদরোগের ঝুকি।

ভালো বা খাওয়ার উপযোগী মাশরুম চেনার উপায়- How to identify good or edible mushrooms

মাশরুম যেমন অনেক উপকারি একটি খাবার, তেমনি মাশরুম খাওয়ার আগে সঠিকভাবে মাশরুম চেনা অত্যান্ত জরুরি। কারণ, বিষাক্ত মাশরুমও দেখতে খাওয়ার উপযোগী মাশরুমের মতই দেখায়। নিম্নে দেখুন ভালো ও খাওয়ার উপযোগী মাশরুমের বৈশিষ্ট্য-
  • দেখতে হবে তাজা এবং  পরিস্কার।
  • হালকা মাটির গন্ধ বা কোন গন্ধ থাকবে না।
  • চেনা ও পরিচিত স্থান থেকে কেনা, যেমন চাষির ফার্ম, সুপার সপ।
  • কেনার সময় অবশ্যই চেনা প্রজাতির মাশরুম বেচে নেওয়া জরুরি। যেমন-
  1. বাটন মাশরুম- Button mushroom.
  2. শিটাকে মাশরুম- Shiitake mushroom.
  3. অয়েস্টার মাশরুম- Oyster mushroom.
  4. পোর্টোবেলো মাশরুম- Portobello mushroom.

যে সকল মাশরুম খাওয়া উচিত নয়- Mushrooms that should not be eaten

সারা বিশ্বে প্রাপ্ত ১৪,০০০ মাশরুমের মধ্যে যেহেতু, মাত্র ৭০০ প্রজাতির মাশরুম মানুষের খাবারের উপযোগী, তাই মাশরুম খাওয়ার ক্ষেত্রে নিম্নের বৈশিষ্ট্য আছে এমন মাশরুম খাওয়া থেকে বিরত থাকা উচিত। যেমন- 

  • বনে- জঙ্গলে পাওয়া অচেনা উৎসের মাশরুম।
  • যেগুলোতে দুর্গন্ধ বা চটচটে, কালো দাগ আছে এমন মাশরুম।
  • মাশরুমের টুপির নিচে যদি সবুজ বা বেগুনি রঙের ছায়া থাকে এমন মাশরুম।

*** আপনাকে অবশ্যই মাশরুম খাওয়া আগে খেয়াল রাখতে হবে, ভূল মাশরুম খাওয়ার কারণে, বিষক্রিয়া, বমি, পেট ব্যথা এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে,

মাশরুম খাওয়ার সঠিক নিয়ম- The correct rules for eating mushrooms

মাশরুম খাওয়ার যেহেতু উপকারিতার পাশাপাশি অপকারিতাও রয়েছে, তাই মাশরুম খাওয়ার সময় অবশ্যই সঠিক নিয়মে খাওয়া উচিত। নিম্নে মাশরুম খাওয়ার সঠিক নিয়ম সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো- 

*** ভালোভাবে পরিস্কার করা- মাশরুমে যেন মাটি বা ময়লা লেগে না থাকে, তাই রান্নার আগে ভালোভাবে ধুয়ে নিতে হবে। ব্রাশ বা পাতলা কাপড় দিয়েও পরিস্কার করা যায়।

আরো পড়ুনঃ টিউমার হওয়ার কারণ কি কি?- টিউমার প্রতিরোধের ঘরোয়া উপায়

*** রান্না করে খেতে হবে- অনেক ধরণের মাশরুম রয়েছে, যেগুলো কাচা খেলে হজম সমস্যা হতে পারে। তাই, রান্না করলে এর টক্সিন হয় ও খাবারের স্বাদও বাড়ে।

*** স্বাভাবিক পরিমাণে খাওয়া- মাশরুম প্রথমবার অল্প পরিমাণে খেয়ে শুরু করুন। দেখুন আপনার শরীরে অ্যালার্জি বা অন্য সমস্যা হয় কিন না।

*** বাচ্চা ও গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রে- নিরাপদ মাশরুম হলেও, বাচ্চা ও গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

মাশরুম খাওয়ার রেসিপি- Mushroom recipes

ভালো ও খাবারের উপযোগী মাশরুম আমরা কাচা এবং বিভিন্নভাবে রান্না করে খেতে পারি। তবে, বিশেষ কিছু উপায় অবলম্বন করে, রান্না করে খেলে খাবারটি অনেক সুস্বাদু হয়ে থাকে, নিম্নে মাশরুমের তিনটি রেসিপি সম্পর্কে আলোচনা করা হলো- 

মাশরুম ভুনা বা বাংলা স্টাইল

মাশরুম ভুনা রান্নার উপকরণ

  • ২০০ গ্রাম বাটন মাশরুম বা অয়েস্টার মাশরম।
  • ধনে পাতা বা সাজনা পাতা পরিমাণ মত।
  • শুকনো মরিচের গুড়ো পরিমাণ মত।
  • ২ টেবিল চমচ সোয়াবিনের তেল।
  • মাঝারি ২টি পেয়াজের কুচি।
  • হাফ চা চামচ জিরার গুড়ো।
  • হাফ চা চাওমচ হলুদ গুড়ো।
  • ১ চা চামচ রসুন বাটা।
  • ১ চা চামচ আদাবাটা।
  • ১ চা চামচ ধনে গুড়ো।
  • পরিমান মত লবন।
  • ২টি কাচা মরিচ।

মাশরুম ভুনা রান্নার প্রণালি

  • মাশরুম ভালোভাবে ধুয়ে পাতলা করে কেটে নিন।
  • কড়ায়ে তেল গরম করে পিয়াজ দিন এবং ভাজুন, বাদামি রঙ না হওয়া পর্যন্ত।
  • এখন রসুন ও আদা বাটা দিয়ে ২ মিনিটের মত নাডুন।
  • এবার হলুদ, মরিচ, ধনে ও জিরার গুড়ো দিয়ে হালকা পানি দিয়ে কষান।
  • এখন মাশরুম দিয়ে কয়েক মিনিট নাড়ুন পানি শুকানো পর্যন্ত।
  • কাঁচা মরিচ ও ধনে পাতা দিয়ে একটু নাড়ার পর ঢেকে রাখুন ২/৩ মিনিট।
  • আপনার মাশরুম ভুনা রান্না শেষ, গরম ভাত বা রুটির সঙ্গে নিজে খান এবং অতিথিদের পরিবেশন করেন।

মাশরুম কারী বা মাঝারি ঝোল

মাশরুম কারী রান্নার উপকরণ

  • ২৫০ গ্রাম মাশরুম।
  • ১ কাপ পানি।
  • ২টি পেয়াজ কুচি।
  • ১টি টমেটো কুচি।
  • পরিমাণ মত লবন।
  • ২ টেবিল চামচ তেল।
  • ১টি আলু দিতে পারেন।
  • হাফ চা চামচ গরম মসলা গুড়া।
  • ১ চা চামচ করে আদা ও রসুন বাটা।
  • ১ চা চামচ করে হলুদ, মরিচ ও ধনে গুড়ো।

মাশরুম কারী রান্নার প্রণালি

  • মাশরুম ও আলু ধুয়ে কেটে নিন।
  • তেল ও পিয়াজ দিয়ে ভেজে আদা বাটা দিন।
  • মসলা এবং টমেটো দিয়ে ভালো ভাবে কষান।
  • এখন আলু ও মাশরুম দিয়ে ভালোভাবে মিশান।
  • এবার পানি দিয়ে ঢেকে ১০/১২ মিনিট সেদ্ধ করুন।
  • পরিমাণ মত ঝোল মেপে নিন এবং গরম মসলা দিন।
  • আপনার মাশরুম ভুনা রান্না শেষ, গরম ভাত বা রুটির সঙ্গে নিজে খান এবং অতিথিদের পরিবেশন করেন।

ক্রিসপি ফ্রাইড মাশরুম বা স্ন্যাকস বা সাইড ডিশ

মাশরুম ক্রিসপি ফ্রাইডের উপকরণ

  • ২০০ গ্রাম মাশরুম।
  • ১ টি ডিম।
  • পরিমাণমত লবন।
  • ২ টেবিল চামচ ময়দা।
  • ৪ টেবিল চামচ কর্ণফ্লাওয়ার।
  • ভাজার জন্য তেল পরিমানমত।
  • হাফ চা চামচ গোল মরিচ গুড়ো।

মাশরুম ক্রিসপি ফ্রাইডের প্রণালি

  • প্রথমে মাশরুম ভালোভাবে ধুয়ে শুকিয়ে নিন।
  • ময়দা, ডিম, লবন। কর্ণফ্লাওয়ার এবং মরিচ মিশিয়ে ব্যাটার তৈরি করুন।
  • এবার মাশরুমগুলো ব্যাটারে ডুবিয়ে গরম তেলে ভেজে নিন, যেন লালচে দেখায়।
  • আপনার রান্না প্রস্তুত, এখন আপনি সস বা মায়োনেজের সঙ্গে মিশিয়ে পরিবেশন করুন।

সুস্বাদু খাবার মাশরুম- শেষকথা- Delicious food mushrooms

মাশরুম একটি অত্যান্ত পুষ্টিকর, স্বাস্থ্যকর এবং অত্যান্ত সুস্বাদু খাবার, যা, আমাদের প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। তবে, মাশরুন সঠিক উপায়ে চেনে এবং নিরাপদ কোন উৎস থেকে কেনে খাওয়া উচিত। কারণ, ভুলভাবে মাশরুম খেয়ে বিপদ হতে পারে।

মাশরুম আমাদের স্বাস্থ্য উপকারিতার পাশাপাশি এটি দিয়ে তৈরি করা যায়, বিভিন্ন মুখরোচক রেসিপি, যা আমাদের খাবারের স্বাদ বাড়ায় এবং শরীরকে রাখে সুস্থ্য ও সবল। সে কারণে সচেতনতার সঙ্গে বাছাই করে ও নিয়ম মেনে মাশরুম খেলে, আমরা এর প্রকৃত উপকারিতা অর্জন করতে সক্ষম হবো।

আরো পড়ুনঃ মাথা ব্যথা হওয়ার কারণ কি?- মাথা ব্যথা থেকে মুক্তি পাওয়ার ঘরোয়া উপায়

আর্টিকেলটি যদি আপনাদের ভালোলাগে ও উপকারি বলে মনে হয় তাহলে এটি আপনার পরিচিতদের সঙ্গে শেয়ার করবেন, তারাও যেন উপকৃত হন। আরো নতুন নতুন তথ্য জানার জন্য আমাদের পরবর্তী আর্টিকেল পড়ুন এবং আমাদের সঙ্গে থাকুন, ধন্যবাদ।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url